প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ৯ আগস্ট ‘সমুদ্র নিরাপত্তা বৃদ্ধি : আন্তর্জাতিক সহযোগিতা’ বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিতর্কের সভাপতিত্ব করেন। শুধু এটিই নয়, অনেক দিক বিবেচনায় এটি ছিল ঐতিহাসিকভাবে প্রথম ঘটনা। এই প্রথমবারের মতো কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার আলোচ্যসূচির আওতায় এই প্রথমবারের মতো সমুদ্র নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হলো।

নিরাপত্তা পরিষদ অতীতে জলদস্যুতা এবং সমুদ্রে সশস্ত্র ডাকাতি সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও এ ধরনের সামগ্রিক আলোচনা এটিই প্রথম। পরিশেষে ভারতের আহ্বানে আয়োজিত এই আলোচনা উপলক্ষে নিরাপত্তা পরিষদ সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি সভাপতির বিবৃতি গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সভাপতির বিবৃতি এটিই প্রথম। পরিষদের সদস্য ১৫টি রাষ্ট্রের সবাই সর্বসম্মতভাবে তা অনুমোদন করে।

ওই বিবৃতি ২৬/১১ মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার মতো সন্ত্রাসীদের সমুদ্র ব্যবহারের বিষয়টি নজরে এনেছে এবং এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর অনুশীলন ভাগ করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। উপরন্তু, এটি সমুদ্রে আন্তর্দেশীয় সংঘবদ্ধ অপরাধের ক্রমাগত সমস্যা আমলে নিয়েছে। ওই বিবৃতিতে মহাসাগরের বৈধ ব্যবহার, সমুদ্রযাত্রী এবং উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ওই আলোচনায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর উচ্চ পর্যায়ের অংশগ্রহণ ছিল। সেখানে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান পর্যায়ের চারজন এবং মন্ত্রী পর্যায়ের ১০ জনের উপস্থিতি ছিল। এটি ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থানের পাশাপাশি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বৈশ্বিক মর্যাদাকে প্রতিফলিত করে। প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর মন্তব্যে সমুদ্র নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামো হিসেবে পাঁচটি নীতি প্রস্তাব করেন। এর মধ্যে ছিল বৈধ সামুদ্রিক বাণিজ্যের বাধা দূর করার প্রয়োজনীয়তা; সমুদ্রসীমা বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সমাধান করা; যৌথভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সমুদ্রে অ-রাষ্ট্রীয় ক্রীড়নকদের হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করা; সামুদ্রিক পরিবেশ ও সম্পদ সংরক্ষণ এবং দায়িত্বশীল সামুদ্রিক কানেক্টিভিটিকে উৎসাহিত করা। এই পাঁচটি নীতি হলো সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদারে ভারত ঘোষিত অবস্থানের একটি স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী প্রথম সাগর বা ‘এ অঞ্চলে সবার জন্য নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি’ ধারণাটি প্রকাশ করেছিলেন।

এরপর ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরের সাংগ্রি-লা সংলাপে তিনি তাঁর বত্তৃদ্ধতায় ভারতের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপকল্পের রূপরেখা দিয়েছেন। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ব্যাংককে ইস্ট এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় উদ্যোগ’ চালু করেন। সেখানে তিনি সমুদ্র অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার সাতটি ভিত্তি প্রস্তাব দেন। সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার উপকূলরেখা এবং এক হাজার ২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভারতের নীতিতে মহাসাগরগুলো সব সময় কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিল। আমাদের সমৃদ্ধ সামুদ্রিক ইতিহাস অন্তত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। তখন সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার অধিবাসীরা মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্য করত। গুজরাটের লোথালে বিশ্বের প্রথম ‘ডকের’ (জাহাজ থেকে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামার স্থান) প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ হাজার হাজার বছর আগেও সমুদ্রযাত্রী জাতি হিসেবে ভারতের দক্ষতার সাক্ষ্য দেয়।

আজ ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হচ্ছে সমুদ্রপথে। সমুদ্রপথগুলো পারস্পরিক সমৃদ্ধির পথ এবং শান্তির জন্য করিডর হিসেবে উপস্থাপিত হওয়াই আমাদের স্বার্থ। মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণে প্রথম সাড়া দেওয়াসহ ভারত মহাসাগর অঞ্চলে এবং এর বাইরে নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে ভারত তার স্বাক্ষর রেখেছে। পশ্চিম ভারত মহাসাগরে প্রতিবেশীদের অনুরোধে দ্রুত সাড়া দেওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘সাগর’ ও ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’—উভয় রূপকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

গুরুগ্রামে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের জন্য ‘তথ্য ফিউশন সেন্টার (আইএফসি-আইওআর)’ সামুদ্রিক তথ্য বিনিময়ের একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সেখানে বেশ কয়েকটি দেশ লিয়াজোঁ কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনী জলদস্যুতাবিরোধী অভিযান জোরদার করেছে। তারা এর পাশাপাশি অংশীদার দেশগুলোকে প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা দিচ্ছে। সামুদ্রিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ সহযোগিতার একটি নতুন খাত। এ খাতে সহযোগিতা চাওয়া শ্রীলঙ্কা ও মরিশাসের সাহায্যের আহ্বানে ভারত সাড়া দিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গত সোমবারের আলোচনায় বেশ কয়েকজন বক্তা উল্লেখ করেছেন, পরিষদের বিবেচনার বাইরে ছিল এমন একটি বিষয় ভারত সাফল্যের সঙ্গে আলোচনায় এনেছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

এর আগে নিরাপত্তা পরিষদে সামুদ্রিক নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগগুলো স্থায়ী পাঁচ সদস্যসহ অন্য সদস্যদের ভিন্ন ভাবনার কারণে সফল হয়নি। সোমবারের বিতর্ক মতপার্থক্যের কারণগুলো স্পষ্টভাবে বের করে এনেছে। তবু নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনার ফল হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতির বিবৃতি আকারে একটি দলিল গ্রহণ করে। ভারতের বৈশ্বিক মর্যাদা এবং তার গঠনমূলক সেতুবন্ধমূলক ভূমিকা পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে বিশ্বব্যাপী জটিল সমস্যাগুলো আসলেই অগ্রসর হতে পারে। সভাপতি হিসেবে এই উন্মুক্ত আলোচনা আয়োজনের মাধ্যমে ভারত বিশ্বমঞ্চে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনকারী হিসেবে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে।

আমাদের বিশ্বাস, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার ও সমসাময়িক বাস্তবতার প্রতিফলনের মাধ্যমে অসংখ্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যেতে পারে। আমাদের সভাপতিত্বের প্রথম নিদর্শনী অনুষ্ঠান ওই বিশ্বাসকে আরো জোরালো করেছে। আর ভারত বিখ্যাত ‘হর্সশু টেবিলে’ (ঘোড়ার নালের মতো দেখতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনার টেবিল) স্থায়ী সদস্য হিসেবে তার ন্যায্য স্থান নিতে যাচ্ছে।

লেখক : ভারতের পররাষ্ট্রসচিব (ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকায় গতকাল বুধবার প্রকাশিত নিবন্ধ)